১। হযরত আসমা বিনতে ইয়াজিদ আনসারী (রঃ) হুজুরের দরবারে এসে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার মাতা-পিতা আপনার নামে কোরবান হোক, মুসলমান নারীদের পক্ষ হতে প্রতিনিধি হিসেবে আমি আপনার খেদমতে হাজির হয়েছি। নিশ্চয় আল্লাহ পাক নারী এবং পুরুষ উভয়ের জন্য আপনাকে নবী করে পাঠিয়েছেন, তাই আমরা নারী মহলও আপনার উপর এবং আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি কিন্তু আমরা ঘরের কোণে, পর্দার অন্তরালে থেকে শুধু পুরুষের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে থাকি। এতদসত্ত্বেও পুরুষগণ অনেক ব্যাপারে সওয়াবের দিক দিয়ে আমাদের চেয়ে অগ্রগামী থাকে। তারা জুম্মার নামাযে শরিক হয়, জামায়াতে নামায পড়ে, রোগীর দেখাশুনা করে, যানাযার নামাযে শরিক হয়, হজ্জের পর হজ্জ করে থাকে, সর্বোপরি তারা জেহাদে শরিক হয়। আর তাঁরা যখন হজ্জ, ওমরা ও জিহাদ ইত্যাদিতে গমন করে, তখন আমরা তাদের জন্য কাপড় বুনেথাকি। আমরা কি ছওয়াবের বেলায় পুরুষদের সমান অংশীদারি হতে পারি না? হুজুর সাহাবাদের প্রতি মুখ ফিরায়ে, এরশাদ করলেন, হে আমার সাহাবারা। ধর্মের ব্যাপারে এ মহিলার চেয়ে উত্তম প্রশ্নকারী তোমরা কখনও দেখেছ কি?” সাহাবাগণ উত্তরে বললেন, মেয়েলোক যে এ রকম প্রশ্ন করতে পারে, তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি।” অতঃপর প্রিয় নবী, হযরত আসমার দিকে লক্ষ্য করে বললেনঃ “মনোযোগ দিয়ে শোন এবং বুঝে লও, আর যে সব মেয়েদের তুমি প্রতিনিধি হয়ে এসেছ, তাদেরকে বলে দাও যে, স্বামীর খেদমত করা, তা’দের সন্তুষ্টি তালাশ করা উল্লেখিত সমস্ত সওয়াবেরই সমতুল্য।” (ফাজায়েলে আমাল)
২। হযরত আলি (রা.) একজন শিষ্যকে বললেন, আমি আমার এবং হুজুরের কন্যা ফাতেমার বর্ণনা শুনাব কি? শিষ্য বলল, নিশ্চয়ই শুনান। তিনি ফরমাইলেন, হযরত ফাতেমা ছিলেন পরিবারের মধ্যে হুজুরের সবচেয়ে আদরের, হযরত ফাতেমা স্বহস্তে চাক্কি চালাতেন, সে কারণে তার হাতে দাগ পড়ে যেত, মশক ভরে স্বয়ং পানি আনতেন, যার ফলে তাঁর বুকে রশির দাগ পড়ে যেত, ঘর নিজ হাতে ঝাড়ু দিতেন যদ্দরুন কাপড়-চোপড় প্রায়ই ময়লা থাকত। একদা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খেদমতে অনেকগুলো গোলাম বাঁদী আসে। আমি ফাতেমাকে বললাম: তোমার আব্বাজানের খেদমতে গিয়ে যদি একজন খাদেম চেয়ে আনতে, তবে তোমার কাজ-কর্মে অনেক সাহায্য হতো। হযরত ফাতেমা আমার কথামত গিয়ে দেখেন যে, তখন হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে লোকজনের খুব ভীড়, তাই হুজুরকে কিছু না বলে ফেরত আসলেন। পরের দিন স্বয়ং নবীয়ে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের এখানে তশরীফ এনে ফরমাইলেনঃ “মা ফাতেমা, গতকাল তুমি কিজন্য গিয়েছিলে? তিনি লজ্জায় কিছু বললেন না। আমি আরজ করলাম হুজুর, তিনি চাক্কী চালাতে চালাতে হাতে দাগ পড়ে গিয়েছে। ঘরে ঝাড় দেয়ার কারণে, প্রায়ই কাপড়-চোপড় ময়লাযুক্ত থাকে।
গতকাল হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খেদমতে কিছু গোলাম বাঁদী আসায় আমি বলেছিলাম, একটা খাদেম চেয়ে আনলে হয়তো তোমার কাজ-কর্মে কিছুহুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করলেন : ফাতেমা, আল্লাহকে ভয় কর, তাঁর ফরজ আদায় করতে থাক। তুমি ঘরের কাজকর্ম নিজ হাতে করতে থাক এবং যখন শয়ন করবে তখন ৩৩ বার সোবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবর পড়িয়া লও। এই আমল খাদেম হতে উত্তম। মা ফাতেমা উত্তরে বললেনঃ আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ব্যবস্থার উপর সন্তুষ্ট আছি। অন্য হাদিসে আছে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দুই ফুফাতো বোন এবং ফাতেমা হুজুরের খেদমতে গিয়ে নিজেদের কষ্টের কথা প্রকাশ করে খাদেম চাইলেন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করলেন, “খাদেম পাওয়ার বেশি উপযুক্ত হইল বদরের এতিমগণ। আমি তোমাদের খাদেম হইতে উত্তম জিনিস বাতলাইতেছি, উহা হইল প্রত্যেক ফরজ নামাযের পর ৩৩ বার সোবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ ও ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পড়িবে এবং একবার পড়িবে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু লাহুল মুলক ওয়ালাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়্যিন ক্বাদির।” হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপন পরিবারবর্গ ও প্রিয়জনদেরকে বিশেষভাবে এসব তাসবীহ পাঠের নির্দেশ দিতেন। উপরের হাদিস পার্থিব কষ্ট ও পরিশ্রমের মোকাবেলায় হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সব তাসবীহ শিক্ষা দিয়েছেন, এর জাহেরী কারণ এই যে, মুসলমানের জন্য দুনিয়ার কষ্ট কোনো কষ্টই নয়। তাদেরকে ক্ষণস্থায়ী পার্থিব কষ্ট হতে দৃষ্টি হটিয়ে আখেরাতের চিরস্থায়ী শান্তির সামগ্রী বাড়াবার জন্য উৎসাহ দেয়া হয়েছে।
একটি হাদিসে এসেছে, কোনো জায়গায় আগুন লাগলে “আল্লাহু আকবর” বেশি বেশি পড়তে থাক। কেননা এটা আগুনকে নিভিয়ে দেয়। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমাইছেন : অধিক পরিমাণ শারীরিক পরিশ্রম হলে অথবা শক্তি বৃদ্ধির ইচ্ছা করলে, শুইবার সময় ৩৩ বার সোবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ, ৩৪ বার আল্লাহু আকবর পড়বে। হযরত ফাতেমাকে খাদেমের বদলে তাসবীহ পাঠ শিক্ষা দিয়েছেন। এসব তাসবীহ পাঠ করলে শারীরিক পরিশ্রমের অবসানমোল্লা আলী ক্বারী এবং ইবনে হাজার (রঃ)ও এ কথা লিখেছেন : আল্লামা ছুয়ূতী (রঃ) মেরকাতুছ ছউদ গ্রন্থে লিখেছেন, এর দ্বারা আখেরাতের তো উপকার হবেই, দুনিয়াতেও খাদেমের সাহায্যে যত উপকার পাওয়া যায় তার চেয়ে বেশি উপকার হয়। কারণ এ দ্বারা কাজের মধ্যে এমন শক্তি ও সাহস পাওয়া যায় যা খাদেম দ্বারা সম্ভব নয়। একটি হাদীসে আছে, দু’টি অভ্যাস এমন আছে যার উপর আমল করতে পারলে বেহেশতে দাখিল হওয়া যায়। আমল দু’টি বড় সহজ, কিন্তু এর উপর আমল করনেওয়ালা খুব কম। প্রথমত এই সব তাসবীহকে প্রত্যেক নামাযের পর দশ দশ বার পাঠ করবে। যা পড়া হিসেবে দেড়শ বার কিন্তু আমলের পাল্লায় এটা দেড় হাজার গণ্য হবে। আর শোবার সময় সুবহানাল্লাহ ৩৩ বার, আলহামদুলিল্লাহ ৩৩ বার এবং আল্লাহু আকবার ৩৪ বার পড়বে। এটা পড়া হিসেবে একবার হলেও সওয়াব হিসেবে এক হাজার বার হবে। কেউ জিজ্ঞেস করল হুজুর, এটা কেমন কথা যে, এর উপর কম লোকেই আমল করে থাকে। এরশাদ হলো নামাযের সময় শয়তান এসে বলে যে, অমুক কাজ রয়েছে আর শোয়ার সময় বিভিন্ন ঝামেলা মনে করিয়ে দেয়, ফলে তাসবীহ পড়া বাদই থেকে যায়। এখানে আর একটি কথা প্রণিধানযোগ্য যে, খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা (রা.) যিনি বেহেশতের নারীদের সর্দার হবেন, তিনি স্বহস্তে আটা পিষতেন ফলে হাতে দাগ পড়ে যেত। মশক টানতে টানতে বুকে রশির নিশান পড়ে যায়। ঘরের কাজকর্মে করতে গিয়ে কাপড় অপরিষ্কার হয়ে যেত। অর্থাৎ যাবতীয় কাজ তিনি নিজ হাতে সমাধা করেন, আর আমাদের স্ত্রীদের অবস্থা হলো তার সম্পূর্ণ বিপরীত, যাদের জীবনী আমাদের জন্য আদর্শ যাদের উপর গর্ব করে থাকি। উচিত ছিল যে আমরা গোলাম হয়ে সেই মনিবদের চেয়ে অধিক পরিমাণে কষ্ট স্বীকার করি, কিন্তু